হিউয়েন সাঙ ছিলেন বিখ্যাত চীনের পর্যটক । তিনি উত্তর ভারতের সম্রাট হর্ষবর্ধন (৬০৬ - ৬৪৭) খ্রিষ্টপূর্ব এর রাজত্বকালে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের কোন এক সময়ে তিনি ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন,এবং ৬৩৮খ্রিস্টাব্দ তিনি বাংলায় প্রবেশ করেন। তখন এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম
প্রভাবশালী ছিল ।
বৌদ্ধ আমলে শিক্ষা ব্যবস্হা :
হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে বৌদ্ধ যুগের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম থেকে জানা যায় যে শিশু শিক্ষার্থী সর্বপ্রথম পরিচিত হতো ‘সিদ্ধম’-এর সঙ্গে অথবা দ্বাদশ অধ্যায়যুক্ত প্রাথমিক পুস্তকের সঙ্গে।
শিশুরা সাত বছর বয়সের আগেই বারো অধ্যায়ের সিদ্ধ-বাস্তু পাঠ করত।
ওই পুস্তকে সংস্কৃত বর্ণমালা ও স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের যৌথ বিন্যাস ছিল। বলা হয়ে থাকে যে সিদ্ধম, সিদ্ধবাস্তু বা সিদ্ধবস্তু মহেশ্বর প্রথম শিখিয়েছিলেন এবং শিশুরা এটা ছয় মাসে মুখস্থ করে। ছয় বছর বয়সে শিশুরা সিদ্ধ-বাস্তু মুখস্থ করত। সিদ্ধবাস্তু ব্যাকরণের প্রথম অধ্যায় মাত্র।
সাত বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ করার পর তা শেষ হলে উচ্চ শিক্ষাভিলাষী কিশোরেরা ১৬ বছর বয়সের পর পঞ্চবিদ্যা শিখত।
সাধারণত ১৬ বছরের কম বয়সীরা এই শিক্ষা গ্রহণের অনুমতি লাভ করত না—কারণ, এই শিক্ষা গ্রহণের জন্য নিজগৃহ ছেড়ে দূরবর্তী স্থানে চলে যেতে হতো। হিউয়েন সাঙের মতে, এই পঞ্চবিদ্যা হচ্ছে শব্দবিদ্যা, শিল্পস্থানবিদ্যা, চিকিত্সাবিদ্যা, হেতুবিদ্যা ও অধ্যাত্মবিদ্যা।
সিদ্ধ-বাস্তুতে এসব অক্ষরযোগে ৩০০ শ্লোক থাকত, যা মুখস্থ করতে হতো। চারটি পদে তৈরি একটি শ্লোকে ৩২টি শব্দাংশ থাকত। এরপর আট বছর বয়সে আট মাস ধরে ব্যাকরণের মূল সূত্রগুলো মুখস্থ করতে হতো।
সকাল থেকে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত টোলে পাঠদান তারপর স্নান-আহার। বিকেলে আবার ভ্রমণের সময় গঙ্গাতীরে শিষ্যসঙ্গে মণ্ডলী করে বসে পাঠাদির আলোচনা—এভাবেই দিবা অতিবাহিত ।
মোঘল আমলে শিক্ষা
ব্যবস্হা :
মুসলিমদের আগমনে ভারতের শিক্ষাধারা আবার ভিন্ন মাত্রা পেতে থাকে।
মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠ্যক্রমের মধ্যে ছিল ব্যাকরণ, বাগ্মিতা, তর্কবিদ্যা, ব্রহ্মবিদ্যা, অধিবিদ্যা, সাহিত্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, ঔষধশাস্ত্র এবং ব্যবহারশাস্ত্র। মোগল যুগের শেষ ভাগে পাঠক্রমে যুক্তিভিত্তিক বিজ্ঞানগুলোর প্রাধান্য দেখা যায়। সম্রাট আকবর-সৃষ্ট ভাষা শিক্ষার পদ্ধতিটিও উল্লেখযোগ্য।
পড়তে শেখার পরে লিখতে শেখার ফারসি পদ্ধতিটির পরিবর্তে লিখতে শেখার সঙ্গে সঙ্গে পড়তে শেখার পদ্ধতিটিকেই তিনি গ্রহণযোগ্য মনে করেন। সময় বিভাজনও ঘোষিত হয়েছিল। যথা উচ্চারণসহ অক্ষর শেখার জন্য দুদিন, অক্ষরগুলো সাজানোর জন্য এক সপ্তাহ। তারপর অক্ষর সংযুক্ত করে ধর্মীয় ও নীতিশিক্ষাসংবলিত ছোট গদ্য ও পদ্য পড়া এবং শেষে নিজে নিজে পড়তে শেখা। আকবর চারটি দৈনিক কার্যসূচি ঘোষণা করেছিলেন—অক্ষর শেখা, অক্ষর সাজানো, নতুন পড়া এবং পুরোনো পাঠের পুনরাবৃত্তি।
মুসলিম সমাজের প্রতিটি শিশু চার বছর চার মাস চার দিন বয়সে উপনীত হলে তাকে সুন্দর পোশাকে সাজিয়ে পরিবারের সব সদস্য ও অন্য স্বজনদের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক জ্ঞান প্রদানের সূচনা করা হতো। শিশুটিকে পবিত্র কোরআনের কিছু অংশ পাঠ করানোর চেষ্টা করা হতো—শিশুটি পড়তে না চাইলে তাকে অন্তত ‘বিসমিল্লাহ’ উচ্চারণ করানোর প্রথা ছিল।
প্রাথমিক অবস্থায় জোর দেওয়া হতো বিশুদ্ধ উচ্চারণের দিকে। পরবর্তীকালে ধারাবাহিকভাবে পান্দনামাহ, আন্দনামাহ, গুলিস্তান, বোস্তান ইত্যাদি ফারসি শিক্ষার গ্রন্থ পাঠ শিক্ষার্থীর জন্য আবশ্যক ছিল।
তা ছাড়া দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ব্যাপার ফারসি ভাষায় প্রকাশ করতে শেখানো হতো।
পাশাপাশি ছাত্রদের ইউসুফ-জোলেখা, লাইলি-মজনুর কাহিনি, সিকান্দারনামাহ, আলেকজান্ডারের বিজয়ের ইতিহাস ইত্যাদি অধ্যয়ন করানো হতো।
প্রাথমিক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী প্রথমে ফারসি নাম, পরে আরবি এবং তারপর অন্যান্য ভাষায় নাম লেখার অভ্যাস করত।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রদের ফারসি-আরবির পাশাপাশি বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রচলন ছিল। বাংলা বহু মুসলমানের মাতৃভাষা ছিল বলে বাঙালি মুসলমানরা মাতৃভাষাকে অবহেলা করতে পারেনি।
বহিরাগত মুসলমানরাও বাংলা ভাষা এবং এ দেশকে নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছিল।