Thursday, November 13, 2025

নোয়াখালী জেলার দক্ষিণে একটা জেলার আয়তনের সমপরিমন ভূমি সমুদ্র হতে জেগে উঠেছে যা হতে পারে দেশের নতুন এক সামুদ্রিক জেলা

 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১০ শতাংশ যখন সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তখন বঙ্গোপসাগরের কোলে জেগে উঠছে ছোট-বড় দ্বীপ ও চরভূমি। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে যেন জাগছে অন্য এক নতুন বাংলাদেশ। গত ৩৩ বছরের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের কোলে এবং এর সংলগ্ন উপকূলীয় অনেক নদী-খাল-খাঁড়ি দিয়ে আসা পলিমাটিতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২০ বর্গ কি.মি. নতুন ভূমি জেগে উঠছে। যুক্ত হচ্ছে মূল ভূখ-ের সাথে। গত চার দশকে ভূমি যোগ হয়েছে দেশের মূল ভূখন্ডের প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ। স্পারসো’র গবেষণায় জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে নতুন দ্বীপ ও চরাঞ্চল ধীরে ধীরে চারপাশে আকারে বড় এবং উঁচু হচ্ছে। জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে আরো অনেক ডুবোচর, দ্বীপ।

 


নতুন নতুন চর ও দ্বীপভূমি জেগে ওঠার প্রক্রিয়ায় প্রধানত উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা। এখানে বঙ্গোপসাগরের কোলে ছোট ছোট অনেকগুলো দ্বীপ ও চরাঞ্চল। শত শত নদ-নদী দিয়ে মেঘনার মোহনা হয়ে আসা পলিমাটি-বালু সাগর উপকূলে গিয়ে জমতে জমতে জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ চর ও দ্বীপ ভূমি। তাছাড়া জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে কয়েক ডজন চর ও দ্বীপাঞ্চল।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ১৯১৩ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত একশ’ বছরে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে নোয়াখালী উপকূল ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণে সরে গেছে। দ্বীপভূমিতে চাষাবাদ শুরু হওয়ার সাথে জনবসতি গড়ে উঠেছে।


নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলায় নতুন নতুন দ্বীপ ও চর ভূমি জেগে উঠে ক্রমাগত ভূমি সম্প্রসারণের ফলে হাতিয়া উপজেলা শিগগিরই একটি জেলার সমান আয়তনে রূপ নিতে চলেছে। কাগজে-কলমে হাতিয়া উপজেলার আয়তন ২ হাজার একশ’ বর্গ কি.মি. হলেও ছোট-বড় অন্তত ২৫টি দ্বীপ ও চর মিলে এর আয়তন দ্বিগুণেরও বেশি।

অন্যদিকে গোটা নোয়াখালী জেলার আয়তন ৪ হাজার ২০২ দশমিক ৭০ বর্গ কি.মি.। হাতিয়াকে ঘিরে নতুন চর বা দ্বীপের আয়তন কোনো কোনোটি উপজেলার সমান। হাতিয়ায় জেগে ওঠা নিঝুম দ্বীপ, স্বর্ণদ্বীপের আয়তন একেকটি উপজেলার আয়তনের সমান।

বঙ্গোপসাগর বুকে জেগে ওঠা ৬৫ বর্গ কি.মি. আয়তনের ভাসানচর (ঠেঙ্গার চর) এখনও হাতিয়ার অন্তর্ভুক্ত। তবে সন্দ্বীপ উপজেলার সীমানায় পড়েছে মর্মে দাবির সমর্থনে তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা করছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রশাসন।


হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ লাগোয়া নতুন চর ও দ্বীপ ভূমি জেগেছে চর কবিরা, চর কালাম, চর আলীম, সাগরিয়া, উচখালী, নিউ ডালচর। হাতিয়া দ্বীপের দক্ষিণ এবং উত্তর দিকে জাগছে আরো নতুন ভূমি। মেঘনার ভাঙনে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় যে পরিমাণ ভূমি বিলীন হয়েছে, এর চারপাশে দ্বিগুণ ভূমি জেগে উঠছে। নতুন নতুন চর ও দ্বীপ ভূমির আয়তন প্রায় ২ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ডুবোচর কিংবা জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে এর চেয়ে দ্বিগুণ চর ও দ্বীপভূমি।

হাতিয়াকে ঘিরে কিংবা এর সংলগ্ন দক্ষিণে ও দক্ষিণ-পশ্চিমে বেশ কয়েকটি নতুন চর ও দ্বীপ জেগে উঠেছে।

বন বিভাগের তথ্যমতে, নতুন করে জেগে ওঠা চরগুলোর মধ্যে

চরঘাসিয়ার আয়তন ৫ হাজার ১ একর,

ঢালচর ৪ হাজার,

চর আতাউর ৫ হাজার ৬৮৩,

চর মোহাম্মদ আলী ১ হাজার ১৭১,

দমারচর ৬ হাজার ৩৬০,

চর আয়েশা ৫ হাজার ২১৩,

চর গাঙ্গুরিয়া ১০ হাজার ২,

চর নুরুল ইসলাম ১০ হাজার ৩,

চর প্রিয়া ২ হাজার ৯৯৯,

চর ওছখালী ৭ হাজার ২,

চর ইউনুস ৩ হাজার ৭০০,

নতুন চর ইউনুস ৭০০,

চরকমলা ১৩ হাজার ৩৩৯,

চর ওসমান ৫ হাজার ৫০০,

চর মুয়িদ ৩ হাজার ৩০০,

চর কবিরা ২ হাজার,

চর কালাম ৮ হাজার ৭৮৫,

খাজারচর ৪ হাজার ৫০০,

চর রৌশন ৪ হাজার ৫০০

ও চর জোহান ৫ হাজার ৭০০ একর।

 

এর মধ্যে প্রায় সবগুলো চরের ৪৫ হাজার একর জমি উদ্যানের আওতায় আনা হয়েছে।

স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, ইতিমধ্যে বসতি গড়ে উঠেছে চর ঘাসিয়া, ঢালচর, চর আতউরসহ কয়েকটি চরে। চর মোহাম্মদ আলী, দমারচর, চর জোনাক, চর গাঙ্গুরিয়া, চর নুরুল ইসলাম, চর প্রিয়া, চর ওছখালীসহ কয়েকটি চরে ধান চাষের পাশাপাশি রয়েছে গরু, মহিষ ও ভেড়ার বাতান।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরগুলো কয়েক ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেলে নৌকা ও গাছে অবস্থান নিয়ে মানুষ রক্ষা পেলেও প্রাণহানি হয় নিরীহ পশুর। জোয়ারে প্লাবিত হওয়ায় একাধিকবার ধান চাষ করেও কৃষকদের পক্ষে মাত্র একবার ফলন ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে। এরপরও প্রতিবছর কয়েক লাখ টাকার কৃষিপণ্য উৎপাদন হয় বিচ্ছিন্ন এসব চরে। তবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে চরগুলো কৃষির আওতায় আনা হলে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

হাতিয়ার চারপাশে প্রাকৃতিকভাবে যেভাবে ভূমি জেগে উঠছে, আগামী ১৫-২০ বছর পর চরগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত হয়ে বড় এলাকা হয়ে উঠবে। সরকারিভাবে এসব চরে বাঁধ দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হলে কৃষি, শিল্প কারখানাসহ অনেক কিছু করা সম্ভব। এ ছাড়া নদীভাঙা ও ভূমিহীন মানুষগুলোকে পুনর্বাসন করা যাবে এসব চরে। চরগুলোকে উৎপাদনমুখী করে গড়ে তুলতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

https://www.ajkerpatrika.com/bangladesh/noakhali/ajphhzgtsqicj

ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, ১৯১৩ সালে নোয়াখালী উপকূলের তটরেখা ছিল বর্তমান জেলার সোনাপুরের কাছাকাছি। তবে পরের ১০০ বছরে তা ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণে প্রসারিত হয়ে কেয়ারিংচরে এসে ঠেকে। মূলত মেঘনার ভাঙন থেকে নোয়াখালীকে রক্ষা করতে ১৯৫৭ ও ১৯৬৪ সালে দুটি ক্রসড্যাম নির্মাণ করা হয়। ফলে পলিমাটি জমে সেই অঞ্চল উঁচু হয়ে যায়, আশপাশে নতুন চর জেগে উঠতে শুরু করে। এ ছাড়া ১৯৮৬ সালে ফেনী নদীর মোহনায় মুহুরী বাঁধের কারণে বিশাল চরের বিকাশ ঘটে। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত এ সীমানা আরও প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে প্রসারিত হয়েছে। মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা ছোট চর ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। অচিরেই যা দেশের মূল ভূখণ্ডে যুক্ত হবে। 

বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) তথ্যমতে, বাংলাদেশে নতুন ভূখণ্ড জেগে ওঠার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্প। হিমালয় থেকে নদীগুলো বেয়ে বিপুল পরিমাণ পলি নেমে আসতে থাকে। ফলে ১৯৪৩ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রতিবছর ৪৩ বর্গকিলোমিটার করে ভূমি জেগে ওঠে। ওই সময়ই নোয়াখালী ও ফেনী জেলার বেশিরভাগ ভূমি গড়ে ওঠে। 

ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) হিসাবে, ১৭৮০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ২০০ বছরে বাংলাদেশের দক্ষিণে ৬২৯ বর্গকিলোমিটার আয়তন বেড়েছে। পরের ৪১ বছরে ভূমি উদ্ধার প্রকল্প ও চর উন্নয়ন এবং বসতি স্থাপন প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন করা হয়েছে আরও ৮৩ হাজার ৭৯৮ একর জমি। গত ১০০ বছরে নতুন জেগে ওঠা চরের তালিকায় রয়েছে- নোয়াখালী উপকূলের নিঝুমদ্বীপ, নলেরচর ও কেয়ারিংচর; চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার উত্তর-পশ্চিমে উড়ির চর ও পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে ভাসানচরসহ অনেক দ্বীপ। প্রায় দুই দশক আগে জেগে ওঠা ভাসানচরে ইতোমধ্যে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে। ভাসানচরের দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে জেগেছে ১০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের গাঙ্গুরিয়ার চর। এখানে চাষাবাদও শুরু হচ্ছে। ফলে সেখানকার মানুষের অনেকাংশে বেকারত্ব দূর হবে। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে।

অন্যদিকে মেঘনার অব্যাহত ভাঙনে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় ভূমি যেমন বিলীন হচ্ছে, তেমনি এর বিপরীতে চারপাশে অন্তত ১০ গুণ ভূমি জেগে উঠেছে। হাতিয়ার পশ্চিমে নতুন করে জেগে উঠেছে ঢালচর, চর মোহাম্মদ আলী, চর ইউনুস, চর আউয়াল, মৌলভীর চর, তমরুদ্দির চর, জাগলার চর, ইসলামচর, নঙ্গলিয়ার চর, সাহেব আলীর চর, দক্ষিণে কালামচর। এ ছাড়া হাতিয়া নদীতে সাতটি নদীর মধ্যে কলাতলী, তেলিয়ার চর, বদনার চর, ঢালচর ও মৌলভীর চরে বনায়ন ও চাষাবাদ চলছে। আগামী এক দশকে এসব চরের আয়তন হবে প্রায় ৫০০ বর্গকিলোমিটার। এ ছাড়া বরিশাল, খুলনাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাগরের বুক চিরে জেগে উঠছে নতুন চর। এসব চরের ভূমির পরিমাণও প্রায় ৩৩ হাজার বর্গকিলোমিটার হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে ভূমি সচিব মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সারা দেশে জমির সীমানা নির্ধারণে স্থায়ী ডিজিটাল পিলার বসানোর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। নদীভাঙনে ভূমির সিকস্তি ও পয়স্তি হলেও সীমানা সুনির্দিষ্ট থাকবে। জরিপ ও মৌজা ম্যাপ চূড়ান্ত না হলে চরের বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে না। 

সিইজিআইএসের রিমোট সেন্সিং ডিভাইস বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, ১৯৭৩ সাল থেকে নোয়াখালী উপকূলে নতুন চর জেগে ওঠা নিয়ে কাজ করছে সরকার। স্যাটেলাইট ইমেইজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিবছর প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার নতুন ভূখণ্ড যুক্ত হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও পদ্মা নদী দিয়ে পলি নেমে আসার পরিমাণ কমেছে। একই সঙ্গে নতুন জেগে ওঠা চর বিভিন্ন কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া নদীভাঙনও বৃদ্ধি পেয়েছে।

https://protidinerbangladesh.com/special-news/34344/ ম্যাপের-আগে-নতুন-চর-বন্দোবস্ত-নয়


শেয়ার করুন

0 comments: